en

কাতার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দেশ কাতার। দেশটির রাজধানী দোহায় অবস্থিত। কাতার বর্তমান পৃথিবীর একটি আলোচিত দেশ এবং অনেক আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে জড়িয়ে আছে। মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের অন্যতম সহযোগী দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর থেকে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের আলোচনার মূল বিন্দুতে চলে আসে। আজ আপনাদের জন্য কাতার সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। কোন প্রকার সংযোজন বিয়োজন করার ক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ প্রত্যাশী।

ইতিহাস

কাতার ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কাতার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জসিম বিন মোহাম্মদ আল থানি। পরবর্তীতে বংশানুক্রমে শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি কাতেরের আমীর নির্বাচিত হন।

৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মোহাম্মদ (স) তৎকালীন কাতারে একদল সাহাবিকে পাঠান ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য এবং সেখানকার শাসক মঞ্জির ইবনে সাওয়া আল তামিমি ইসলাম গ্রহণ করে সে সময় থেকে কাতার মুসলমানদের অধীনে চলে আসে।

১৭৮৩ সাল পর্যন্ত এই ভূখণ্ডটি আব্বাসি খেলাফত এবং অটোমান সম্রাজ্জের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর সৌদি আরব এবং সবশেষে বাহরাইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সম্রাজ্জের পতনের পর ব্রিটিশরা কাতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯১ সালে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে কাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইরাকের বিরুদ্ধে সৌদি বাহিনীকে সমর্থন দেয়ার জন্য কাতার আমেরিকা, কানাডা এবং ফ্রান্সের সাথে সামরিক চুক্তি করে যার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা কাতারে একটি সেনা ঘাটি স্থাপন করে।বর্তমানে কাতারে ১২০০০ মার্কিন সৈনিক রয়েছে।

১৯৯৫ সালে আমীর হামাদ বিন খলিফা আল থানি ফ্রান্স, প্রতিবেশী দেশ এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে তার পিতা খলিফা বিন হামাদ আল থানিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। আমীর তামিম বিন হামাদ -এর সময়ে কাতেরের সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে।

এসময় তিনি আলজাজিরা টেলিভিশন চালু, নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সহ আরও উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। ২০১৭ সালের জুন মাসে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর এবং বাহরাইন কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

পরবর্তীতে ইরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন, তুরস্কের সামরিক ঘাটি প্রত্যাহার, মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন, আল জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধসহ তের দফা শর্ত দিয়ে অবরোধ তুলে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কাতার এই প্রস্তাবকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ আখ্যায়িত করে নাকচ করে দেয়।

ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, ধর্ম ও ভাষা

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত ছোট রাষ্ট্র কাতারের আয়তন ১১,৫৮১ বর্গকিলোমিটার। দেশটি ৫০ থেকে ৫২ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা এবং ২৪ থেকে ২৭ ডিগ্রী উত্তর অক্ষ রেখায় অবস্থিত। কাতারের সময় জিএমটি +৩। দেশটিতে পানির পরিমাণ ০.৮%। এখানে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম এবং শীতকালে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে।

২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী কাতেরের জনসংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ ৭৫ হাজার ৫২২ জন। এর মধ্যে ৩,১৩,০০০ কাতারি এবং বাকি সব প্রবাসী। কাতারে বসবাসরত জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৬৮% মুসলিম, ১৩% হিন্দু, ১৩% খ্রিস্টান এবং ৩% বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস করে। ২০০৮ সাল থেকে কাতার সরকার খ্রিস্টানদের চার্চ নির্মাণ করার অনুমতি দেয়।

কাতারের রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবি। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বাংলা, হিন্দি, বেলুচ, মালায়লাম, উর্দু, পাশতু, নেপালি এবং ইন্দুনেশিয়ান ভাষাও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

অর্থনীতি

কাতার অর্থনৈতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধশালী। পৃথিবীর তৃতীয় প্রাকৃতিক তেল এবং গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ কাতার। কাতার ১৯৪০ সালে প্রথম "দুখান" তেলকুপ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে।

১৯৪০ সালের আগে কাতারের অর্থনীতি সামুদ্রিক মাছ এবং মুক্তা আহরণের উপর নির্ভর ছিল। বর্তমানে কাতারের নাগরিকদের কোন ধরনের আয়কর দিতে হয় না। বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেশটি পৃথিবীর প্রথম অবস্থানে রয়েছে।

কাতার ১৯৬১ সালে পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের সদস্যপদ লাভ করে। দেশটি বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠন করেছে। যার মাধ্যমে পৃথিবীর বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে থাকে।

তাছাড়া, কাতার চ্যারিটি বিশ্বের অনেক দেশে তাদের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে যা আন্তর্জাতিকভাবে কাতারকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। কাতার বিমান পরিবহণ সংস্থা "কাতার এয়ারলাইন্স" খুবই পরিচিত।

রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থা

দেশটিতে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু আছে। ১৮২৫ সাল থেকে আল থানি পরিবার কাতার শাসন করছে। কাতেরের একটি সংবিধান রয়েছে যা মজলিশ এ শূরার ৪৫ সদস্যের মধ্যে ৩০ সদস্যের সম্মতিক্রমে পাশ হয়েছে।

দেশটিতে ইসলামী শরিয়া আইন চালু রয়েছে। দেশের সকল আইনের মূল উৎস হচ্ছে কুরআন। দেশটির বর্তমান আমীর তামিম বিন হামাদ আল থানি ২০১৩ সালের ২৫ জুন তার পিতার নিকট থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

কাতারের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তালিকায় প্রথম সারিতে রাজতান্ত্রিক আরব দেশসমূহ ছিল। কিন্তু তামিম বিন থানি ক্ষমতায় আসার পর সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমিরাত থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছে যার প্রমান দেখা যায় ২০১৭ সালে কাতারের উপর অবরোধ আরোপের মাধ্যমে।

অবরোধের পর থেকে কাতার ইরান, তুর্কি এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেয়। কারন অবরোধের সময় ইরান এবং তুর্কি কাতারকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে। তুরস্ক কাতারে তাদের সামরিক ঘাটি স্থাপনের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের সামরিক হুমকির হাত থেকে নিরাপত্তা দিয়েছে।

ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে কাতার সর্বাত্মক সমর্থন করছে। তাছাড়া ইসরাইলী হামলায় বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার পুনর্গঠনের জন্য কাতার বিভিন্ন সময় অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে।

সামরিক শক্তি

কাতার সামরিক বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২,০০০। এর মধ্যে ৮,৫০০ সেনাবাহিনী, ২,০০০ নৌবাহিনী এবং ১,৫০০ বিমানবাহিনীর অন্তর্গত। দেশটি তাদের মোট বার্ষিক উৎপাদনের প্রায় ৪.৫% সামরিক খাতে ব্যয় করে।

১৯৯৪ সালে কাতার আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের সাথে এক সামরিক চুক্তি করে যার প্রেক্ষিতে দেশের সবচেয়ে বড় বিমান ঘাটি আল উদেইদ যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। কাতার পৃথিবীর অন্যতম সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃত।

পর্যটন খাত

সম্পদশালী দেশ কাতারে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তার মধ্যে কাতারা মসজিদ, কাতার কেন্দ্রীয় মসজিদ, রাজধানী দোহায় অবস্থিত দোহা মরুভূমি, আল যুবারা দুর্গ, রহস্যময় আল জাসসাসিয়া ভাস্কর্য, আল ওয়াকরা যাদুঘর, কাতার জাতীয় যাদুঘর, বারজান টাউয়ার, দোহা দুর্গ এবং ইসলামিক শিল্প যাদুঘর উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও কাতারের আকাশচুম্বী সব ভবন এবং বিস্ময়কর স্থাপনা সারা বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে সমাদৃত।

সংবাদ মাধ্যম

কাতার রাষ্ট্রীয় প্রচার এবং বিনোদনের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শীর্ষক আইন পাশ করে। যার প্রেক্ষিতে বিখ্যাত আলজাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল চালু করে। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী কাতেরের কোন সংবাদমাধ্যম থানি পরিবার এবং আমিরের বিরুদ্ধে কোন সংবাদ প্রচার করতে পারবে না।

কাতারে মোট সাতটি সংবাদপত্র প্রকাশ হয়। এর মধ্যে চারটি আরবি এবং তিনটি ইংরেজি ভাষার। তাছাড়া, কাতারে কয়েকটি বিদেশী পত্রিকা যেমন নেপালি, বাংলা, শ্রীলঙ্কান এবং হিন্দি ভাষায় ছাপা হয়।

বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক এবং দূতাবাস

কাতেরের সাথে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। কাতার চ্যারিটি বাংলাদেশে অসংখ্য এতীমখানা, মসজিদ, বিদ্যালয় এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। কাতারে বাংলাদেশের প্রায় ১২৩,০০০ প্রবাসি শ্রমিক কর্মরত আছেন।

বাংলাদেশ ২০১৭ সালে কাতার থেকে প্রাকৃতিক তরল গ্যাস আমদানির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলো প্রথম বিদেশে সম্প্রচার শুরু করে কাতারে। বাংলাদেশ এবং কাতার সামরিক ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করতে আগ্রহী।

বাংলাদেশে অবস্থিত কাতার দূতাবাসের ঠিকানা - বাড়ি #১, রোড #৭৯, গুলশান #২, ঢাকা- ১২১২।

আরও পড়ুন:-

কপিরাইট © ২০১৮ রংতুলি চয়েস ইনফো